আজকের আর্টিকেলে আমরা উদ্ভিদ কাকে বলে? উদ্ভিদের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব

উদ্ভিদ কাকে বলে?
উদ্ভিদ কাকে বলে- উদ্ভিদ হলো একপ্রকার জীব, যা সবুজ শৈবাল থেকে শুরু করে বৃহৎ বৃক্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। উদ্ভিদগুলো সাধারণত সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যালোক, জল, এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করে। এদের মধ্যে শিকড়, কান্ড, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি অংশ থাকে।
উদ্ভিদের কিছু উদাহরণ হলো:
- *. বৃক্ষ: আমগাছ, নারকেল গাছ, বটগাছ, জামগাছ।
- *. ফুলগাছ: গোলাপ, গাঁদা, জবা, রজনীগন্ধা।
- *. ফলগাছ: কলাগাছ, পেয়ারা গাছ, লেবু গাছ।
- *. শস্য: ধান, গম, ভুট্টা, আলু।
- *. শাকসবজি: পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, ঢেঁড়স।
- *.লতাগুল্ম: মানকচু, কুমড়ো, লাউ, পুঁইলতা।
এগুলো উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরণের উদাহরণ, যেগুলো বিভিন্ন প্রকারের পরিবেশে জন্মাতে পারে এবং বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য
উদ্ভিদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা: অধিকাংশ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের আলো, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং পানি ব্যবহার করে গ্লুকোজ বা খাদ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনও উৎপন্ন হয়, যা পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- স্থিরতা: উদ্ভিদ সচরাচর স্থির থাকে, অর্থাৎ চলাচল করতে পারে না। তারা শিকড়ের মাধ্যমে মাটিতে আবদ্ধ থাকে, যা তাদেরকে স্থির থাকতে এবং মাটি থেকে পানি ও পুষ্টি গ্রহণ করতে সাহায্য করে।
- কোষ প্রাচীর: উদ্ভিদের কোষগুলোতে সেলুলোজ দ্বারা তৈরি শক্ত কোষ প্রাচীর থাকে, যা তাদেরকে আকার এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করে।
- প্রজনন ক্ষমতা: উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজনন প্রক্রিয়া আছে। অনেক উদ্ভিদ ফুলের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে, যা থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। কিছু উদ্ভিদ অযৌন প্রজননের মাধ্যমে নতুন উদ্ভিদ তৈরি করতে পারে, যেমন কাটিং বা মুকুল।
- বৃদ্ধি: উদ্ভিদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিকড়, কান্ড এবং পাতা বৃদ্ধি পায় এবং নতুন শাখা-প্রশাখা গঠিত হয়।
- শ্বাস-প্রশ্বাস: সালোকসংশ্লেষণের পাশাপাশি, উদ্ভিদও শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত করে, যা জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
- পানি ও পুষ্টি শোষণ: উদ্ভিদ মাটির শিকড়ের মাধ্যমে পানি এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি শোষণ করে। এই পুষ্টি তাদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- অভিযোজন: উদ্ভিদ তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। শীতকালীন অঞ্চলের গাছপালা ও গরম অঞ্চলগুলোর গাছপালা বিভিন্ন ধরনের অভিযোজন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে বেঁচে থাকে।
উদ্ভিদের এই বৈশিষ্ট্যগুলোই তাদের জীববৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন: মাটি কাকে বলে? মাটি কত প্রকার ও কি কি?
উদ্ভিদের প্রকারভেদ
ফুল ও ফলের উপস্থিতির ভিত্তিতে উদ্ভিদকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
১. সপুষ্পক উদ্ভিদ (Phanerogams বা Angiosperms)
সপুষ্পক উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যাদের ফুল থাকে এবং প্রজননের মাধ্যমে ফল এবং বীজ উৎপাদন করে। এদেরকে আরও দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়:
- একবীজপত্রী উদ্ভিদ (Monocotyledons): এদের বীজে একটিমাত্র বীজপত্র থাকে।
- উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, কলা।
- দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ (Dicotyledons): এদের বীজে দুটি বীজপত্র থাকে।
- উদাহরণ: আমগাছ, সরিষা, মটরশুঁটি।
২. অপুষ্পক উদ্ভিদ (Cryptogams)
অপুষ্পক উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যাদের ফুল, ফল বা বীজ থাকে না। এদের প্রজনন সাধারণত স্পোরের মাধ্যমে হয়। এই ধরনের উদ্ভিদ প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত:
- থ্যালোফাইটা (Thallophyta): যেমন শৈবাল।
- ব্রায়োফাইটা (Bryophyta): যেমন মস।
- টেরিডোফাইটা (Pteridophyta): যেমন ফার্ন।
★. থ্যালোফাইটা (Thallophyta)
থ্যালোফাইটা হলো উদ্ভিদের একদম প্রাথমিক স্তর। এদের দেহ থ্যালাস আকারের, অর্থাৎ, এদের শিকড়, কান্ড বা পাতা স্পষ্টভাবে থাকে না। এরা সাধারণত জলজ পরিবেশে বা আর্দ্র স্থানে বসবাস করে।
বৈশিষ্ট্য:
- ★এদের প্রজনন স্পোরের মাধ্যমে হয়।
- ★এরা সাধারণত জলজ বা আর্দ্র স্থানে বসবাস করে।
- ★কিছু থ্যালোফাইটা সালোকসংশ্লেষণ করতে সক্ষম, যেমন শৈবাল।
ব্রায়োফাইটা (Bryophyta)
ব্রায়োফাইটাকে কখনো কখনো “স্থলজ উদ্ভিদের পূর্বপুরুষ” বলা হয়, কারণ এরা স্থলজ উদ্ভিদ হলেও সম্পূর্ণভাবে মাটির উপর নির্ভরশীল নয়। এরা সাধারণত আর্দ্র পরিবেশে বৃদ্ধি পায় এবং প্রাথমিকভাবে মাটিতে পানি ধরে রাখতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
- ★দেহে শিকড়, কান্ড ও পাতার আংশিক পার্থক্য দেখা যায়, তবে এগুলো সঠিকভাবে গঠিত নয়।
- ★জল নির্ভর প্রজনন, অর্থাৎ প্রজননের জন্য পানির প্রয়োজন হয়।
- ★মাটির উপরে জন্মায়, তবে আর্দ্র পরিবেশে বৃদ্ধি পায়।
- ★এদের “রাইজয়েড” নামক শিকড় সদৃশ অঙ্গ থাকে যা মাটির সাথে লেগে থাকতে সাহায্য করে।
. টেরিডোফাইটা (Pteridophyta)
টেরিডোফাইটা হলো ক্রিপ্টোগামদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত উদ্ভিদ। এদের শিকড়, কান্ড এবং পাতার স্পষ্ট পার্থক্য থাকে এবং এরা স্থলজ উদ্ভিদ। তবে এদেরও ফুল বা বীজ থাকে না, এবং স্পোরের মাধ্যমে প্রজনন ঘটে।
বৈশিষ্ট্য:
- ★এদের শিকড়, কান্ড ও পাতা স্পষ্টভাবে পার্থক্যযুক্ত থাকে।
- ★এদের vascular system (জাইলেম এবং ফ্লোয়েম) থাকে, যা পানি এবং পুষ্টি পরিবহন করে।
- ★এদের প্রজনন স্পোরের মাধ্যমে হয়।
- ★এরা স্থলজ উদ্ভিদ, তবে আর্দ্র পরিবেশে বৃদ্ধি পায়।
- ★পত্রপুটের নিচের দিকে স্পোরাঞ্জিয়া থাকে, যেখানে স্পোর উৎপন্ন হয়।
সপুষ্পক উদ্ভিদকে ফলের ধরন অনুযায়ী প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
১. খোলাবীজী উদ্ভিদ (Gymnosperms)
খোলাবীজী উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যাদের বীজ ফলের আবরণ দ্বারা ঢাকা থাকে না। অর্থাৎ, এদের বীজ খোলা অবস্থায় থাকে এবং ফল দ্বারা বেষ্টিত হয় না।
বৈশিষ্ট্য:
- * বীজ অনাবৃত অবস্থায় থাকে।
- * এদের ফলের প্রকৃত রূপ নেই।
- * প্রধানত চিরসবুজ ও কাষ্ঠল (Woody) উদ্ভিদ হয়।
- * পত্রপুট বা শঙ্কু আকৃতির পাতা থাকে।
- * প্রজনন শঙ্কুর মাধ্যমে হয়।
২. আবৃত্ববীজী উদ্ভিদ (Angiosperms)
আবৃত্ববীজী উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যাদের বীজ ফলের আবরণ দ্বারা ঢাকা থাকে। এরা ফুলের মাধ্যমে প্রজনন করে এবং ফল উৎপন্ন করে। পৃথিবীর অধিকাংশ উদ্ভিদ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
বৈশিষ্ট্য:
- * বীজ ফলের মধ্যে আবৃত থাকে।
- * এদের ফুল এবং ফল থাকে।
- * এই উদ্ভিদগুলো একবীজপত্রী (Monocotyledon) ও দ্বিবীজপত্রী (Dicotyledon) হিসেবে ভাগ করা হয়।
- * আবৃত্ববীজী উদ্ভিদের মধ্যে ফুল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
অন্যান্য উদ্ভিদ
উদ্ভিদ কাকে বলে তা উদ্ভিদের শ্রেণিবিভাগে সপুষ্পক (Phanerogams) এবং অপুষ্পক (Cryptogams) উদ্ভিদের বাইরে আরও কিছু উদ্ভিদের ধরন রয়েছে, যেগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত হয়। এদেরও বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
১. পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ (Epiphytes):
পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যারা অন্য উদ্ভিদের উপর বসবাস করে কিন্তু পুষ্টি গ্রহণের জন্য পোষক গাছের উপর নির্ভর করে না। এরা মূলত বায়ু এবং বৃষ্টির জল থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সাধারণত অন্যান্য উদ্ভিদের উপরের অংশে বেড়ে ওঠে।
২. পরজীবী উদ্ভিদ (Parasitic Plants):
এই উদ্ভিদগুলো অন্য গাছের উপর পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নির্ভর করে এবং পোষক গাছ থেকে সরাসরি পুষ্টি গ্রহণ করে। এদের নিজস্ব সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া থাকে না বা খুব সীমিত থাকে।
৩. মাংসাশী উদ্ভিদ (Carnivorous Plants):
এই উদ্ভিদগুলো পোকামাকড় বা ছোট প্রাণী ধরে এবং সেগুলোর দেহ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। সাধারণত যেখানে মাটিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি নেই, সেখানেই মাংসাশী উদ্ভিদ দেখা যায়। এদের বিশেষ ধরনের পাতার গঠন থাকে, যা পোকামাকড় ধরতে সহায়ক।
৪. জলজ উদ্ভিদ (Aquatic Plants):
জলজ উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যারা পানিতে বা জলের আশেপাশে বাস করে। এদের বিশেষ ধরনের গঠন থাকে, যা পানিতে বেঁচে থাকতে সহায়ক। এরা ভাসমান বা সম্পূর্ণ পানির নিচে থাকতে পারে।
৫. বায়বীয় উদ্ভিদ (Aerophytes):
বায়বীয় উদ্ভিদ হলো এমন উদ্ভিদ, যারা মাটি ছাড়া বায়ুতে বেঁচে থাকতে পারে। এদের শিকড় মাটির উপর নির্ভর না করে বায়ু এবং বৃষ্টির জল থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে।
৬. উভচর উদ্ভিদ (Amphibious Plants):
এই ধরনের উদ্ভিদ মাটি এবং জল উভয় পরিবেশে বৃদ্ধি পেতে পারে। এরা পানির নিচে ও মাটির উপর উভয় অবস্থায় খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়।
উপকারিতা
পরিবেশগত উপকারিতা:
- *. অক্সিজেন উত্পাদন: সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ।
- *.বায়ু পরিচ্ছন্নতা: দূষণকারী পদার্থ শোষণ করে।
- *.মাটি সুরক্ষা: মাটির ক্ষয় ও ভূমিক্ষয় রোধ।
- *.জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ: পানি শোষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
মানবস্বাস্থ্য উপকারিতা:
- *.পুষ্টি: ফল, সবজি ও শস্য পুষ্টির উৎস।
- *.ঔষধি গুণ: বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত।
- *.মানসিক স্বস্তি: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।
অর্থনৈতিক উপকারিতা:
- *.চাষাবাদ ও খাদ্য উৎপাদন: প্রধান খাদ্য সরবরাহ ও কৃষি ব্যবসার উন্নতি।
- *.কাঠ ও জ্বালানি: নির্মাণ ও অন্যান্য ব্যবহারের জন্য কাঠ ও জ্বালানির উৎস।
- *.বাণিজ্যিক উদ্ভিদ: চা, কফি, তুলা ইত্যাদির বাণিজ্যিক গুরুত্ব।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপকারিতা:
- *.শিক্ষা ও সংস্কৃতি: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যের অংশ।
- *.প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- *.প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সামঞ্জস্য: ভূমিধস, বন্যা ইত্যাদির মোকাবিলা।
সংক্ষেপণ
উদ্ভিদ আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের জন্য অপরিহার্য। এগুলো পরিবেশের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, মানবস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়, এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্য প্রদান করে। উদ্ভিদের মাধ্যমে আমরা অক্সিজেন, পুষ্টি, ঔষধি উপাদান, কাঠ, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পেয়ে থাকি। এছাড়াও, উদ্ভিদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানসিক স্বস্তি প্রদান করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হয়।এ কারণে, উদ্ভিদের সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের সুষম পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।